জ্বালানি তেলের বিকল্পের সন্ধানে রয়েছে বাংলাদেশ

স্টাফ রিপোর্টার

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বহুমুখী প্রভাব পড়েছে বিশ্বজুড়ে। সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে জ্বালানি তেল ও খাদ্যশস্য। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়ার তেল খাত রয়েছে ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায়। এতে ভেঙে পড়েছে তেল আমদানি-রপ্তানির বৈশ্বিক শৃঙ্খলা। যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। এক ধাক্কায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। বেড়েছে সব ধরনের দ্রব্যমূল্য। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিকল্পের সন্ধানে রয়েছে বাংলাদেশ। সম্ভাব্য উৎসের তালিকায় আলোচনায় রয়েছে রাশিয়াও।

নানামুখী নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও বাংলাদেশকে কম দামে তেল কেনার প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া। গত আগস্টের মাঝামাঝি বাংলাদেশের কাছে তেল বিক্রির প্রস্তাব পাঠায় রাশিয়ার তেল উৎপাদন ও বিপণন কোম্পানি রোজনেট। রাশিয়া থেকে প্রায় ৫০ লিটার পরিশোধিত জ্বালানি তেলের নমুনা গত ২৪ আগস্ট ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়।

কিন্তু বৈশ্বিক রাজনৈতিক বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার এ প্রস্তাব ভাবনায় ফেলেছে বাংলাদেশকে। এ অবস্থায় রাশিয়া থেকে তেল কেনা হবে কি না বা সেটি বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত হবে কি না তা নিয়ে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তবে, রাশিয়া থেকে তেল কিনলেও বাংলাদেশের জন্য থেকে যাবে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়ার দিকে না তাকিয়ে থেকে বিশ্বের আরও অনেক দেশ রয়েছে, যাদের কাছ থেকে খুব সহজেই ভালো মানের তেল আনতে পারে বাংলাদেশ।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) সহযোগী অধ্যাপক ড. আমিরুল ইসলাম বলেন, আমরা নাইজেরিয়া থেকে জ্বালানি তেল আনতে পারি, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও আলজেরিয়া থেকেও আনতে পারি। আমি মনে করি, রাশিয়ার সঙ্গেই শুধু কূটনৈতিক কিছু বিষয় আছে। কিন্তু নাইজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আলজেরিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে আনতে কোনো কূটনৈতিক ঝামেলা হবে না। তাদের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।

তিনি বলেন, এসব দেশ ছোট ছোট উৎপাদনকারী হলেও তাদের তেলের মান ভালো। প্রত্যেক দেশের সঙ্গেই আমাদের চুক্তি থাকলো। এসব দেশ থেকে দুই লাখ টন করেও যদি আমরা তেল আনি, তাহলে কোনো সমস্যা হবে না। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আনলেও জাহাজ ভাড়া কম পড়বে।

ভবিষ্যতে যেসব দেশ থেকেই তেল আনুক না কেন দেশের একমাত্র জ্বালানি তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারিকে আরও আপডেট করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের বর্তমান রিফাইনারিটা বেশ পুরোনো। শুধু মধ্যপ্রাচ্যের অ্যারাবিয়ান ক্রুড অয়েলের (অপরিশোধিত) জন্য বানানো এই রিফাইনারি দিয়ে কতদিন চালানো সম্ভব? সংকট মুহূর্তে তো আমাদের ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। তাই ইস্টার্ন রিফাইনারি-২, যেটা তৈরির পরিকল্পনা চলছে, সেটিকে ইউনিভার্সেল রিফাইনারি হিসেবে তৈরি করতে হবে এবং সেটা এখনই সময়, যেখানে অন্তত ১০ ধরনের ক্রুড অয়েল রিফাইন করা যেতে পারে। তারপর আমরা বিভিন্ন দেশ থেকে তেল এনে সেখানে রিফাইন করতে পারবো। তখন তেল নিয়ে কোনো ঝামেলাই হবে না। অনেক পুরোনো রিফাইনারি হওয়ায় ইস্টার্ন রিফাইনারিতে তেল পরিশোধন পুরোপুরি সঠিকভাবে করা সম্ভবও হয় না।

ড. আমিরুল ইসলাম বলেন, পৃথিবীতে ১৬০ ধরনের ক্রুড অয়েল আছে। উৎপাদনকারী সেরা ১০ দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, সৌদি আরব, কানাডা, ইরাক, চায়না, আরব আমিরাত, কুয়েত আছে। এছাড়া ছোট ছোট ৩০টির মতো দেশ আছে, যারা ক্রুড অয়েল উত্তোলন করে। বাংলাদেশে ডিজেল বেশি প্রয়োজন হয়। ডিজেল তৈরির জন্য লাইড ক্রুড আনতে পারলে বেশি ভালো হয়, যেটির আমেরিকান পেট্রেলিয়াম ইনস্টিটিউট গ্রাভিটি (এপিআই গ্রাভিটি) ৩৫ এর ওপরে। পরিবেশ রক্ষার জন্য সালফার কনটেন্ট শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ রাখলেই আমাদের জন্য হয়ে যাবে। এর ওপর যাওয়া ঠিক হবে না। গেলেই পরিবেশ দূষণ হবে।

তিনি বলেন, দেশের মানুষ তো এখন তেলের অনেক ভালো দাম দিচ্ছে। সে অনুযায়ী ভালো তেলও পাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে তেলে ভেজালও থাকে। এক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তিসহ ভালো রিফাইনারি জরুরি। মিনিমাম ১০ ধরনের ক্রুড অয়েল এনে যেন আমরা রিফাইন করতে পারি। শুধু দু-একটা দেশের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে আমাদের তেল আনার ক্ষেত্র আরও বাড়াতে হবে, যাতে আমরা সংকটে না পড়ি।

‘তবে এসব দেশ থেকে তেল আনতে হলে বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন সে বিষয়গুলো দিকেও দেখতে হবে। রাশিয়ার সঙ্গেই হয়তো একমাত্র জটিলতা আছে। এসব দেশ থেকে আরও সহজেই আমদানি করা সম্ভব’ যোগ করেন তিনি।

আরও পড়ুন: রাশিয়ার তেল আমদানি করলেও থাকবে যেসব চ্যালেঞ্জ

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এসব দেশ যে তেল রপ্তানি করে, সেই তেল বাংলাদেশে পরিশোধন কিংবা রিফাইন করার সক্ষমতা আছে কি না সেটা দেখার বিষয়। তাদের কাছ থেকে তেল আনতে হলে আমরা কীভাবে আনবো সেটিও দেখার বিষয়। কারণ অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সরাসরি তেল আনার কোনো সিস্টেম থাকে না। এজন্য তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা নিতে হয়। এরপর দেখতে হবে এসব দেশে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা আছে কি না। ভিন্ন ভিন্ন মুদ্রার সঙ্গে লেনদেন করে বাংলাদেশের কোনো অভিজ্ঞতা আছে কি না সেটিও দেখতে হবে। এর বাইরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কিছুটা কমেছে। সেটিও ভেবে দেখা দরকার।

তিনি বলেন, রাশিয়ার মতো তো আর এসব দেশে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। সেক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না। আন্তর্জাতিক যেসব বাজারে এসব দেশ তেল বিক্রি করে, সেখানে আমাদের কোনো কেনার অভিজ্ঞতা আছে কি না সেটি দেখতে হবে। সরকার চেষ্টা করলে অবশ্যই পারে।

এদিকে রাশিয়া থেকে তেল কেনার বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা চলছে। ভারত যেহেতু রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল কিনছে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশও কিনতে পারবে বলে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, রাশিয়া থেকে ভারত তেল কিনতে পারলে আমরা কেন পারবো না, আমরাও রাশিয়া থেকে তেল আনতে পারবো। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্নআয়ের মানুষের কষ্ট হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির জন্য জ্বালানি তেল দায়ী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *