সিলিন্ডারের দ্বিগুণ হচ্ছে পাইপলাইন গ্যাসের দাম!

স্টাফ রিপোর্টার

মূল্য বিবেচনায় এতদিন পর্যন্ত বোতলজাত লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) চেয়ে পাইপলাইনে সরবরাহকৃত গ্যাসই ছিল তুলনামূলক বেশি সাশ্রয়ী। তবে বর্তমানে এ পরিস্থিতিতে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের মূল্য বাড়িয়ে দ্বিগুণেরও বেশিতে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। জ্বালানির আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ দফায় বাড়ানোর পর সামনের দিনগুলোয় তা আবারো বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সেক্ষেত্রে এলপি গ্যাসের তুলনায় সাশ্রয়যোগ্যতা হারাতে চলেছে পাইপলাইনে সরবরাহকৃত গ্যাস।

এরই মধ্যে পাইপলাইনে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম এলপিজির মূল্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার যাবতীয় লক্ষণ বাজারে উপস্থিত বলে মনে করছেন জ্বালানি খাতের বাজার পর্যবেক্ষকরা। তাদের ভাষ্যমতে, বিষয়টি সামনের দিনগুলোয় আরো স্পষ্ট হয়ে উঠতে যাচ্ছে। স্থানীয় উৎস থেকে সরবরাহের সংস্থান না করার পাশাপাশি এলএনজি আমদানির মাধ্যমে চাহিদা পূরণের প্রবণতায় আন্তর্জাতিক বাজারের যেকোনো অস্থিতিশীলতা আগামীতেও দেশের গ্যাস খাতে নাজুক পরিস্থিতির জন্ম দেবে। সেক্ষেত্রে পাইপলাইনে সরবরাহকৃত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি এ দফাতেই থেমে যাচ্ছে না।

বর্তমানে বাসাবাড়িতে বহুল ব্যবহূত ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের নির্ধারিত মূল্য ১ হাজার ১৭৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা মূল্যে। এ দামে একটি সিলিন্ডার কিনে একজন গ্রাহক তা ব্যবহার করছেন এক-দেড় মাস। অন্যদিকে রান্নার কাজে ব্যবহূত এক চুলার গ্রাহকদের বর্তমানে প্রতি মাসে ৯২৫ টাকা করে বিল দিতে হচ্ছে। বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবে তা বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা করার কথা বলা হয়েছে। দুই চুলার বিল ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ১০০ টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারীদের পরিশোধকৃত প্রতি ঘনফুট গ্যাসের মূল্য ১২ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৭ টাকা ৩৭ পয়সা করার কথা বলা হয়েছে। শিল্প, বিদ্যুৎ, ক্যাপটিভসহ সব শ্রেণীর গ্যাসের বিলও দ্বিগুণ হারে বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। চলতি সপ্তাহেই বিতরণ কোম্পানিগুলোর এ প্রস্তাব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) পাঠানো হয়েছে।

এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়াব) তথ্যমতে, দেশের বাজারে ৪০ লাখ পরিবার রান্নার কাজে এলপি গ্যাস ব্যবহার করছে। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশ এলপি গ্যাস সরবরাহ করছে বেসরকারি অপারেটররা। বর্তমান পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোয় এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের চাহিদা আরো অনেক বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন জ্বালানি খাতের বিশ্লেষকরা।

তাদের ভাষ্যমতে, এমনিতেই পাইপলাইনের গ্যাস সংযোগ নিতে গ্রাহকদের ভোগান্তি অনেক বেশি। আবার গ্যাস না থাকার বিড়ম্বনা ও দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধির কারণে সামনের দিনগুলোয় পাইপলাইনে সরবরাহকৃত গ্যাসের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন ভোক্তারা। এর বিপরীতে চাহিদা বাড়তে পারে সিলিন্ডারে বাজারজাত করা এলপিজির।

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির খবরে বর্তমানে সব শ্রেণীর গ্রাহকের মধ্যেই অস্বস্তি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে আবাসিকের গ্রাহকদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। কোনো কোনো ভোক্তা এরই মধ্যে পাইপলাইনের গ্যাস থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়ার কথাও জানিয়েছেন।

ভবনে নতুন গ্যাস সংযোগ নিতে আবেদন করেছেন মিরপুরের বাসিন্দা আফজাল হোসেন। তিনি বলেন, সাশ্রয়ী হবে এমন বিবেচনায় কয়েক বছর আগে পাইপলাইনের গ্যাসের জন্য তিতাসের কাছে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু বছরের পর বছর যে হারে গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে তাতে সিলিন্ডার গ্যাসই সাশ্রয়ী হতে যাচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হলে জীবন-জীবিকায় অসহনীয় চাপ সৃষ্টি হবে। সরকার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করায় এমনিতেই জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে গেছে। এক্ষেত্রে আবাসিক, শিল্প, বাণিজ্যিকসহ সব শ্রেণীর গ্রাহকের ওপর অতিরিক্ত অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। বিশেষ করে আবাসিক খাতে পাইপলাইনের গ্যাস ব্যবহারকারীদের এ বাবদ খরচ বেড়ে দাঁড়াতে যাচ্ছে দ্বিগুণেরও বেশি।

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি বৈশ্বিক বাস্তবতা। তবে সরকারকে সে বাস্তবতা মেনে নিয়ে এ খাতে ভোক্তাকে সাশ্রয়ী করার পরিকল্পনা থাকতে হবে, যাতে জীবন-জীবিকায় অস্থিরতা তৈরি না হয়। কারণ জ্বালানি তেল-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ভোক্তার ওপর ব্যাপকভাবে চাপ সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে ভোক্তারা সাশ্রয়ী বিকল্পের পথ খোঁজে।

তবে এর পরও এলপিজিকে পাইপলাইনে সরবরাহকৃত গ্যাসের বিকল্প হিসেবে দেখতে নারাজ জ্বালানি বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে তিনি বলেন, গ্যাসের দাম বাড়লে সাশ্রয়ী হিসেবে এলপিজির সম্প্রসারণ হবে, এটি একটি ইতিবাচক দিক। রাজস্ব আয় তো হচ্ছে। তবে এলপিজির সঙ্গে পাইপলাইনের হিসাবটা মেলাতে গেলে কোনোভাবেই সিলিন্ডার গ্যাস সাশ্রয়ী নয়। কারণ এ খাতে শুধু আবাসিক নয়, শিল্প, বিদ্যুৎ, সারসহ অনেকগুলো খাত জড়িত রয়েছে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলো বলছে, বিতরণ কোম্পানিগুলো মুনাফা করার পরেও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই। এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে সাশ্রয়ী গ্যাস থেকে গ্রাহক মুখ ফিরিয়ে নেবে। তখন এলপি গ্যাসের ব্যবহার বেড়ে যাবে। ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের সুযোগ নেবেন। মূলত একটি সিন্ডিকেটকে সুবিধা দিতেই এসব করা হচ্ছে।

কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সাশ্রয়ী মূল্যের বিষয়টি সরকার যেন বিবেচনায় নেয়। বিশেষত দেশের বড় একটি শ্রেণী আবাসিকে গ্যাস ব্যবহার করে। তাদের খরচ বেড়ে গেলে জীবন-জীবিকা কঠিন হয়ে পড়বে। তাছাড়া বিতরণ কোম্পানিগুলো যে প্রস্তাব দিয়েছে, বিইআরসি তার যৌক্তিকতা বিবেচনা করে দেখবে, আমরা এ প্রত্যাশাই করি।

গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর তথ্যমতে, দেশে আবাসিক গ্রাহক সংযোগ রয়েছে ৪০ লাখ ৪০ হাজারের মতো। এর মধ্যে ছয় লাখের মতো গ্রাহক প্রিপেইড মিটার সংযোগ পেয়েছে। বাকি গ্রাহক মিটারবিহীন গ্যাস ব্যবহার করছে। বিপুলসংখ্যক এই গ্রাহক গ্যাস ব্যবহার না করেও বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার বাড়তি বিল বহন করছেন।

স্থানীয় সরবরাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে বর্তমান সংকট তৈরি হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করছে পেট্রোবাংলাও। মূলত এ দুটি বিষয়ের ধারাবাহিকতাতেই দেশে গ্যাসের মূল্যে বিশ্ববাজারের প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছে সংস্থাটি।

এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, দেশে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা মূলত আমদানীকৃত এলএনজির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায়। বৈশ্বিকভাবে পণ্যটির দাম বেড়েছে। এ দাম যাতে গ্যাস খাতে বড় ধরনের প্রভাব না ফেলে তা নিয়ে আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে হিসাব করছি। একটি খসড়াও প্রস্তুত করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *