বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে
বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে বিশেষায়িত ও বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংক রক্ষা করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো ব্যাংক একদিন, দুদিন কিংবা এক বছরে বন্ধ হবার অবস্থায় যায়নি। সঠিক সময়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ব্যাংকগুলো রক্ষা করা সম্ভব ছিল বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।
ব্যাংকের অবস্থা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা এবং তদন্তে ব্যাংকের দুর্বলতাগুলো বের করে আনতে পারলে একাধিক ব্যাংক ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব ছিল। কেন, কী কারণে ব্যাংকগুলোর এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে- তা আইডেন্টিফাই করার দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের; যা করতে পারেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ওরিয়েন্টাল ব্যংক বর্তমানে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক নামে খোড়ায়ে খোড়ায়ে চলছে। শিল্প ঋণ সংস্থা নামে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যখন তলানিতে গিয়ে ঠেকে তখন বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের সঙ্গে শিল্প ঋণ সংস্থাকে merger করা হয়। নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ ডেভেল্পমেন্ট ব্যাংক(বিডিবিএল)। বিডিবিএল খোড়ায়ে খোড়ায়ে চলতে গিয়ে আর চলতে পারছিল না।অবশেষে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে merger করার জন্য রোববার (১২ মার্চ ২০২৪) মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্টান্ডিং(এমওইউ)স্বাক্ষর করেছে। শিল্প ঋণ সংস্থা, বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এবং বিডিবিএল সোনালী ব্যাংক পিএলসি’র মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমান সময়ে পদ্মা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক এবং বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ও বেষিক ব্যাংক বন্ধের দ্বার প্রান্তে চলে গেছে।এই চারটি ব্যাংক যখন ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছিল, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ না করে অবজারভার নিয়োগ করে, পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করেছে। বর্তমানে ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ সদস্যের অধিকাংশ সদস্য এস আলম গ্রুপের প্রতিনিধি অথবা এস আলম গ্রুপের লোক বলে অভিযোগ রয়েছে।
বর্তমানে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮,২০৪ কোটি টাকা- যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৬৩ শতাংশ। আর নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি ৫,১৯৫ কোটি টাকা এবং মূলধন ঘাটতি ২,৩৫২ কোটি টাকা। ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১২,৩৬৮ কোটি টাকা- যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৯ শতাংশ, নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি ১১,৬৯৭ কোটি টাকা এবং মূলধন ঘাটতি ১,৩৭৯ কোটি টাকা। বিডিবিএল’র খেলাপি ঋণ ৯৮২ কোটি টাকা- যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৪২ শতাংশ। পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১,৮৮০ কোটি টাকা- যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৪৬ শাংশ। ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ৪৯৭ কোটি টাকা। রাকাবের খেলাপি ঋণ ১,৫৩৪ কোটি টাকা- যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২১ শতাংশ। মূলধন ঘাটতি ২,৩৮৫ কোটি টাকা।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান ডেইলী অবজারভারকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক সময়ে সঠিকভাবে তদন্ত করতে পারেনি। আর তদন্ত করলেও দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। প্রথমদিকে অন্যায় যারা করেছে; তাদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তি শক্তভাবে প্রয়োগ করলে পরবর্তীতে আর কেউ অন্যায় কাজ করতে সাহস পেত না।
তিনি বলেন, আ্ইন আছে, আর যতি আইন না থাকে- তাহলে আইনের পরিবর্তন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত। আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে- কয়েকটি ব্যাংক ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যেত না। খেলাপি ঋণ সম্পর্কে তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে আরো কঠোর হতে হবে। বৃহৎ ঋণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক দুএকটি ব্যাংককে বৃহৎ ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই নিষেধাঞ্জা আরো আগে গ্রহণ করা যেত। কয়েকটি ব্যাংক শেষ হওয়ার পর এই পদক্ষেপ নিয়ে লাভ কী!
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ন্যাশনাল ব্যাংকের একজন ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা ডেইলী অবজারভারকে বলেন, ব্যাংক ব্যবসা ইমেজের উপর নির্ভর করে সামনে আগায়। ইমেজ সংকটের সৃষ্টি হলে সেই ব্যাংক আর সামনে আগাতে পারে না। তাছাড়া ইমেজ সংকটের সৃষ্টি হলে গ্রাহক আমানত ব্যংকে রাখে না বরং আমানত তুলে নিয়ে যায়। গ্রাহক ব্যাংকে আমানত না রাখলে কখনো ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে পারে না। তিনি বলেন, গ্রাহকের আমানত ব্যাংকে যত বাড়বে, লোকসানের পরিমাণ তত কমবে। বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে কোনো ব্যাংক সামনে আগাতে পারে না।
তিনি আরো বলেন, ব্যাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে যথা সময়ে ফেরত দিতে না পারলে পেলান্টি খেতে হয়। এতে সুদের হার বেড়ে যায়। আর বেশি সুদে টাকা নিয়ে কম সুদে বিতরণ করা এমনিতেই ক্ষতি। তার উপর ওই অর্থ ফেরত না আসলে ক্ষতির পরিমাণ আরো বেড়ে যায়।
হিডেন্স পলিসি তথা ব্যাংকের ভেতরে একনীতি আর বাইরে আরএকনীতি গ্রহণ করে বেশিদিন টিকে থাকা যায় না।এতে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পর্কে তিনি বলেন, ন্যাশনাল ব্যাংকের আজকের এই অবস্থা একদিনে বা দুদিনে সৃষ্টি হয়নি।দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকটিতে অনিয়ম চলচ্ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক এই অনিয়ম চিহ্নিত করার পর কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আজকের এই অবস্থায় ব্যাংকটি আসত না। কারণ অন্যায় করে কোনো ব্যাংক এক বছরের বেশি গোপন করতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ধরি মাছ না ছুই পানি’র মত নীতি অনুস্বরণ করায় ন্যাশনাল ব্যাংক আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক ডেইলী অবজারভারকে বলেন, ন্যাশনাল ব্যাংকের বিরুদ্ধে একাধিকবার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। শতর্ক করা হয়েছে, অবজারভার নিয়োগ করা হয়েছে, পর্ষদ ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয় নাই।
তিনি বলেন, ব্যবসা করে ব্যাংক, লাভ লোকসানের দায়-দায়িত্বও ব্যাংকের। ঋণ প্রদান করা এবং তা আদায় করে থাকে ব্যাংক। ঋণ খেলাপি হলে কিংবা বিতরণকৃত ঋণ আদায় না হলে- তার দায়ভার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিতে পারে না। অন্যায় করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিতরণকৃত ঋণ খেলাপি হলে তা আদায় করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রয়োজনে মামলা করার পরামর্শ দিতে পারে। কিন্তু আদায় করে দিতে পারে না। নিজস্ব ব্যাংককেই খেলাপির টাকা আদায় করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, যেকোনো ব্যাংক অন্যায় করলে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বের হয়ে আসে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির বাইরে কোনো ব্যাংক অন্যায় করতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ যারা মেনে চলে তারা ভালো করে। আর যারা মেনে চলে না তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পুবালী ব্যাংক এক সময় তলানীতে চলে গিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ পর্ষদ মেনে চলেছে। এখন তারা সফল হয়েছে। ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ মানেনি- তাই তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যান্য ব্যাংকও যারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ মানেনি তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।