এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক ৫০-এর নিচে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা
বাণিজ্য সংগঠন আইন ২০২৩-এর বিধি প্রণয়ন করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ বিধি প্রণয়নের কাজ শেষে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) নির্বাচন আয়োজনের কথা রয়েছে। সূত্র জানায়, নতুন এ বিধিতে সংগঠনটির মোট পরিচালকের সংখ্যা ৫০-এর নিচে নামিয়ে আনা এবং মনোনীত পরিচালকের সংখ্যা ১২-তে নামিয়ে আনা হতে পারে।
বর্তমানে এফবিসিসিআই পর্ষদের মোট ৮০ পরিচালকের মধ্যে মনোনীত পরিচালক ৩৪। এর মধ্যে ১৭ মনোনয়ন দেয়া হয় চেম্বার গ্রুপ থেকে। আর অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে ১৭। বাকি পরিচালকরা সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসেন।
৫ আগস্টের পর অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো এফবিসিসিআইয়েও সংস্কারের দাবি ওঠে। এফবিসিসিআই সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম। ১১ সেপ্টেম্বর ফেডারেশনের পর্ষদ বাতিল করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য মো. হাফিজুর রহমান। তাকে ১২০ দিনের মধ্যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করে নির্বাচিত পর্ষদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে বলা হয়। এর পর পাঁচ মাস গেলেও এখনো সংস্কার শেষ না হওয়ায় নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, সংগঠনটিতে সংস্কারের কাজটি আইনের ভিত্তিতেই সম্পন্ন করতে চাইছেন তারা। সরকারের কাছে তাদের তোলা এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য সংগঠন আইন ২০২৩-এর নতুন বিধি প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। কাজটি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, যা সম্পন্ন হলেই এফবিসিসিআই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সংস্কারপ্রত্যাশী এফবিসিসিআই সদস্যদের মতে, দেশের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠনটির নেতৃত্ব নির্বাচনে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব চান তারা। বিগত বছরগুলোর নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংগঠনটির বোর্ডে নির্বাচিত ও মনোনীত পরিচালক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০। গত নির্বাচনেও ৮০ পরিচালকের মধ্য থেকেই প্রেসিডেন্ট-ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছে।
এফবিসিসিআই সংস্কারের দাবি তুলেছেন সংগঠনের সদস্যরা। তাদের এ দাবির প্রেক্ষাপটে বর্তমানে বাণিজ্য সংগঠন বিধি প্রণয়নের কাজ চলছে।
এফবিসিসিআইয়ের বৈষম্যবিরোধী সংস্কার পরিষদের একাধিক সদস্য জানায়, মনোনীত পরিচালক প্রথা বাতিল, পর্ষদ ৩৫-৪০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা, সরাসরি ভোটে সভাপতি, সহসভাপতি ও পরিচালক নির্বাচন, টানা দুবার পরিচালক হওয়ার পর একবার বিরতি—এমন সংস্কার অত্যাবশ্যক।
সংস্কারপ্রত্যাশীরা জানান, ‘আমরা বিগত নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চাই। আগে সংগঠনের জেনারেল বডি ভোট দিতে পারত না। এখন আমরা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন চাই। এতে করে প্রত্যেক সভাপতি প্রার্থীকে সাধারণ সদস্যের কাছে যেতে হবে। তার নির্বাচনী ইশতেহার থাকবে। সে অনুযায়ী তিনি কাজ করবেন এবং নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতিশ্রুত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবেন। এভাবে জবাবদিহি নিশ্চিত হবে। এর মূলে রয়েছে প্রেসিডেন্ট-ভাইস প্রেসিডেন্টকে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। তাকে সাধারণ সদস্যের নেতা হতে হবে। চাপিয়ে দেয়া নেতা চলবে না।’
এফবিসিসিআইয়ের সক্রিয় এক সদস্য বলেন, ‘দুই বারের বেশি কেউ নির্বাচিত হলে তাকে বিরতি দিতে হবে। দেখা গেছে একেকজন পরিচালক সাতবার হয়েছে। দেশ ও জাতির কল্যাণে ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। এজন্যই পরিবর্তন প্রয়োজন। ৪১৭ সংগঠনকে সদস্য বানানো হয়েছে। যার মধ্যে ২০০ সংগঠনের প্রয়োজন নেই। যেমন বাংলাদেশ ফ্ল্যাট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। এ সংগঠনের ট্রেড লাইসেন্সও নেই। এ ধরনের সংগঠনগুলোকে আইনগতভাবে বাদ দিতে হবে। বাণিজ্য সংগঠন আইন ২০২৩-এর বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে এগুলো সম্ভব।’
এফবিসিসিআই প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান দায়িত্ব গ্রহণের পর সদস্যদের দাবির ভিত্তিতে সংস্কারের জন্য ১২টি প্রস্তাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। এতে এফবিসিসিআইসহ সব বাণিজ্য সংগঠনকে রাজনীতিমুক্ত করার পাশাপাশি সরাসরি ভোটের মাধ্যমে সভাপতি, সহসভাপতি ও পরিচালক নির্বাচনের সুপারিশ করা হয়। ফেডারেশনের পরিচালকের সংখ্যা কমানো; অফিস বেয়ারারের পদ সর্বোচ্চ চারজনে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়। মনোনীত পরিচালকের বিধান বাতিলেরও সুপারিশ করা হয়। যদি মনোনীত পরিচালক রাখতেই হয়, তবে সে সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। মনোনীত পরিচালকদের ভোটাধিকার থাকবে না।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু সংস্কার প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমরা যারা ২০২১-২৩ মেয়াদে ছিলাম, আমাদের সংস্কার প্রস্তাব ছিল। সেখানে বলা হয়েছিল একই ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। এতে করে নতুন নেতৃত্ব আসতে পারছে না। সেজন্যই বিরতির প্রস্তাবটি ভালো। পরিচালকের সংখ্যা কমিয়ে আনার পরিকল্পনাটিও সঠিক। কারণ এত পরিচালকের কাজ নেই। পরিচালক বেশির ভাগই হন সিআইপি হওয়ার জন্য। তারা কোনো কাজ করেন না। সময় ও মেধা দেন না। কোনো অবদান রাখেন না। তাই পরিচালকের সংখ্যা কমানো উচিত। প্রস্তাব দিয়েছিলাম খাতভিত্তিক পরিচালক করা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে এফবিসিসিআই সদস্যদের প্রস্তাব আমলে নিয়ে বিধি প্রণয়নের কাজ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বিধির খসড়ায় শুরুতে এফবিসিসিআইয়ের পর্ষদে পরিচালকের সংখ্যা বর্তমানের ৮০ জন থেকে কমিয়ে ৬৮ জনে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছিল। পাশাপাশি প্রস্তাব ছিল মনোনীত পরিচালকের সংখ্যা ৩৪ থেকে কমিয়ে চারজনে নিয়ে আসার। এফবিসিসিআই পর্ষদে একজন সভাপতি, একজন সিনিয়র সহসভাপতি এবং চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে তিনজন করে মোট ছয়জন সহসভাপতি হতে পারবেন বলে খসড়ায় আমলে নেয়া হয়।